সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় আমাদের চিন্তা ও কাজের নবতর নির্দেশনা
(ছাত্র আন্দোলন থেকে নেয়া হয়েছে)
একটি ̄স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭১ সালে। সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পূর্ব-বাংলা বেরিয়ে এসে পাকিস্তানিদের পরিবর্তে বাঙালীদের শাসন কায়েম করলে ও জনগণের স্বাধীনতা ও নিপীড়ন মুক্তির কোনো গণতান্ত্রিক আকাংক্ষাই এই রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হয় নি। এর কারণ নিহিত আছে শোষকদের জাতিগত চরিত্র পাল্টালেও যে শ্রেণির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তার ঐতিহাসিক গঠন ও শ্রেণির চরিত্রের মধ্যে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের যে অংশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছিল তারা মোটেই রাজনৈতিক স্বাধীন ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ছিল না। তাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি প্রোথিত ছিল ঔপনিবেশিক কাঠামোয় বেড়ে ওঠা অনুৎপাদক মুৎসুদ্দির সুবিধাবাদী ও গণবিচ্ছিন্নতার মধ্যে কেননা তারা ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রয়োজনে সৃষ্ট দেশীয় মুৎসুদ্দিদেরই বিশ শতকীয় সংস্করণ। এই অবস্থায় ব্যাখ্যা ব্রিটিশ-ভারত তথা বাংলা সমাজ বিকাশে ধারার পর্যালোচনা থেকে।
ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতীয় সামন্ত সমাজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল কিন্তু সে পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ শর্তের ও তার শক্তিতে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলো ইংরেজ শাসন, তা কার্যতঃ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াদের প্রত্য̈ক্ষ উপনিবেশে পরিণত হলো। ফলে ভারতের স্বাভাবিক বিকাশধারা স্থায়ীভাবে বাধাগ্রস্থ হলো। তারপর থেকে এই ভূখন্ডের জনজীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামজিক আন্দোলন সব কিছুর ওপরই উপনিবেশিক শাসকদের আধিপত্য বজায় থাকলো। সেই আধিপত্বের প্রভাবেই এখানে যা কিছু হতে থাকলো তার উদ্দেশ্য ইউরোপিয় বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার আয়োজনকে অব্যহত রাখা। তার দেশীয় প্রতিনিধিদের রক্ষা ও প্রতিপত্তিময় করে তোলা।
এর ঐতিহাসিক পরিণতিতে এখানে বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো। কিন্তু সেই সংস্কৃতি অন্তসারশূণ্য, নিঃশর্ত আনুগত্যের ও বন্ধ্যা চরিত্রের। এখানে উন্নয়নের নামে অনেক কিছু করা হলো কিন্তু উন্নয়ন শাসকদের যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু তাও আবার জনগণের প্রয়োজন ও ঐতিহাসিকতার অর্জনকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে। এখানে শিক্ষাদীক্ষায় আধুনিকতা প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু সেই শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির মানসলোক হলো উচ্চমন্য। আধুনিকতা জনগণের অভিজ্ঞতা, জনগণের ঐতিহ্যিক ভাবসম্পদকে অবজ্ঞা করলো, তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলো। এখানে রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিবাদ ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত প্রতিষ্ঠা হলো ঠিকই কিন্তু তা জনগণের সংগ্রামের লক্ষ্য সর্বোপরি গণস্বার্থকে বিবেচনা করলো না। কৃত্রিমভাবে গ্রহণ করলো ইউরোপিয় বুর্জায়াদের কায়দা-কানুন ও আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের প্রকরণ। এখানে সমাজ সংস্কারের জোয়ার দেখা গেল। উনিশ শতকীয় জোব্বা পরিহিত মহাপুরুষরা জাতিকে উদ্ধার করতে নামলেন কিন্তু তার মধ্যে নিহিত ছিল জনগণের প্রতি অশ্রদ্ধা, বিদেশী মতের নির্ভরতা। উপরন্তু তা ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, আভিজাত্য ইত্যাদি প্রশ্নকে যথাযথভাবে ফয়সালা করতে না পারার কারণে রাজনৈতিক চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধার্মিকতার প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত করলো।
এই অবস্থার বিপরীতে নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী ও কৃষক জনগণ প্রতিবাদ, অর্ভ্যূথান, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে গেছেন। যদিও লড়াইয়ের এই ধারা এমনভাবে বিকশিত হতে পারেনি যাতে করে ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রভাবে বেড়ে ওঠা বুর্জোয়া সংস্কৃতির এবং মধ্যবিত্তের গষ্ঠিবদ্ধ রাজনীতিকে নাকচ করে নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যতকে মুক্ত করার দিকে আগুয়ান থাকতে পারে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত থেকে আগত বিপ্লবী এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক ধারা উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে মীমাংসায় অপারগ ও উদাসীন থাকার কারণে প্রতিবাদী আন্দোলনের ধারা প্রথম থেকেই দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে চলতে থাকলো।
এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বাধীন রাজনীতি দেশকে বিভক্ত না করে নিজেদের শাসন কায়েম করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার ছাড়া জনগণের মধ্যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তাই ’৪৭-এর দেশ ভঙ্গের কেন্দ্রে থাকে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো প্রবল সাম্প্রদায়িক বিবেচনা। যা কার্যতঃ জনগণের সাথে শাসকশ্রেণির ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
যদিও দেশ ভাগের প্ররোচনা ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যে, তবুও ’৪৭ এর পর পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো বস্তুগত ভিত্তি আর রইল না। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন বিরোধী সম্প্রদায়। সেই হিন্দু সম্প্রদায় দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের নিপীড়ন ইত্যাদির কারণে বিতাড়িত হবার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলমানদের একক আধিপত্য। সেই আধিপত্যের মুখে অবশিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায় এতই ক্ষুদ্র ও দুর্বল যে তাকে দেখিয়ে এখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। এটাই হলো সেই কারণ, যে কারণে মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক দল এখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়। গঠিত অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি। সেই ভিত্তির মধ্যে যতটুকু সাম্প্রদায়িক অবশেষ ছিল তা-ও দুর্বল হয়ে যায় ভাষা আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে। ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতাকে দুর্বল করলেও শক্তিশালী করলো পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সম্ভাবনাকে।
কিন্তু উপনিবেশ প্রতিপালিত মধ্যবিত্ত স্বাধীনতা পেলেও সাংস্কৃতিকভাবে হীনমন্য, অর্থনীতি বিস্তারে পঙ্গু, রাজনৈতিকভাবে গণবিরোধী হবার কারণে তার দ্বারা কোনো সুস্থ জাতীয়তার বিকাশ ঘটলো না, ঘটলো একদিকে উগ্র জাতীয়তা, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের নির্ভরতার বিকাশ। যে ’৭১-এর পরে এই মধ্যবিত্ত যখন পূর্ণ শাসনক্ষমতা পেল, তখন তাদের এই উগ্র জাতীয়তা রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদ এবং অর্থনৈতিকভাবে লুন্ঠন তৎপরতায় নিয়োজিত হলো। ভেতরে তখনও রয়ে গেল সাম্পধদায়িকতা ও জাতি বিদ্বেষের সূত্র প্রভাব।
এর বিপরীতে বিপ্লবী আন্দোলনও তার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা না করে একমুখে নৈরাজ্যিক অন্য মুখে সুবিধাবাদী লেজুড়পনার দোলাচলে বন্দী থাকলো। সংগঠনের রাজনৈতিক তৎপরতা জনগণের সাথে সম্পর্ক ও নিজেদের ইতিহাস প্রভৃতিকে নির্মোহ দ্বাদ্বিক বিশ্লেষণে দেখতে পারার পরিবর্তে বুর্জোয়া প্রবনতা, মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা ও ইউরোপ-রাশিয়া-চীন প্রভৃতির প্রতি আনুগত্যের মধ্যে ভরসা খুঁজতে ব্যস্ত রইলেন। যাতে করে জনগন, শ্রমিক শ্রেনি ও তার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সাথে বিপ্লবী আয়োজনের কোনো সেতু রচিত হলো না বরং দিনে দিনে সেই সেতু আরও ভেঙ্গে গিয়ে চিন্তাগতভাবে উদ্দেশ্যহীন, নাবালকসুলভ এবং সাংগঠনিকভাবে অথর্বই হয়ে থাকল।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনও এর শিকার, এর দুর্বলতার প্রভাবাধীন। বিপ্লবী রাজনীতির নামে যখন মধ্যবিত্তের প্রাধন্যই কর্মসূচি ও নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেই রাজনীতি শাসক বুর্জোয়ার ভূয়া জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের মধ্যে আটকে থাকে, সেই বিপ্লব জনগণের প্রকৃত স্বার্থকে ধারণ করতে পারে না। উপরন্তু শাসক শ্রেণির কর্মসূচির পেছনেই শামিল হয়। তখন এই ধরনের তৎপরতা থেকে বিপ্লবীধারার ছাত্র আন্দোলন যে বিকশিত হতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে মূল রাজনীতির মতো ছাত্র রাজনীতিও প্রতিক্রিয়া নির্ভর থেকে গেছে। অর্থাৎ শাসক রাষ্ট্রের কোনো না কোনো কর্মকান্ডের প্রতিবাদ-বিরোধিতার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। নিজেদের দিক থেকে কী বৃহৎ রাজনীতি থেকে কী ছাত্র রাজনীতি কোথাও ̄স্বতন্ত্র অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে এমন কর্মসূচি দেখা যায়নি। আমাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে এ সত্য প্রমাণিত হবে। তেভাগা আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যূত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর নাগরিক গণ অভ্যূত্থান প্রভৃতি ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রত্যেকটিতেই অংশগ্রহণ করেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিন্তু কর্মসূচি এমনভাবে দেখিয়েছে যে, সেই চেষ্টা-উদ্যোগ-পরিশ্রম ও রক্তক্ষয় থেকে ফায়দা লুটেছে জনগণের শত্রুরা। এরই ফলশ্রুতি বাংলাদেশে বুর্জোয়াদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন এদিক থেকে অগ্রসর হলেও এর অর্জনও ছিনতাই হয়ে গেছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত অংশ হিসেবে বুর্জোয়াদের ওপর থেকে শ্রেণির আনুগত্য পরিহার করে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির অধিন্যস্ত না হবার কারণেও আন্দোলন সংগ্রাম ভেতর থেকেই দুর্বল রয়ে গেছে। সংগঠনে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদিতা-আপোষকামিতা ও নৈরাজ্যবাদী আচরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোট কথা প্রতিক্রিয়া জায়গায় ক্রিয়া করা, শাসক-কর্তার লুণ্ঠন শাসনের মাধ্যমে বা বৈধতা দানকারী না হয়ে নিজেরাই কর্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করা, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সহায়ক লক্ষ্যে̈ কাজ চেষ্টা থেকে আমাদের ছাত্র আন্দোলন সর্বদাই পিছিয়ে ছিল। ছাত্র কোনো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শ্রেণি নয়। বরং তারা এরকমই কোনো শ্রেণির অংশ। মধ্য̈বিত্তের ভেতরেই তার বসবাস, তার চিন্তার বিকাশ। কিন্তু মধ্য̈বিত্ত শ্রেণি নিজেও কোনো মৌলিক শ্রেণি নয়। গঠনের দিক থেকে নির্ভরশীলতার বিচারে মধ্য̈শ্রেণি মালিক বুর্জোয়ারই সহযোগী-তারই অনুগত। সে কারণেই রাজনীতিগতভাবে আনুগত্যের̈ এই বন্ধন ছিন্ন না করে, শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শকে ধারণ না করে কী সমাজ কী নিজেদের বর্গ-কারুরই অগ্রগতি সাধন হতে পারে না। ছাত্র সমাজের মুক্তির লড়াই তাই আমাদের কালে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির লড়াইয়ের সহযোগী হয়ে উঠতে বাধ্য।
অন্য̈দিকে বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। গত কয়েক দশক ব্যাপি পুঁজিবাদ আরও বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে, পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে ব্যাপকভাবে। দেশীয় রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী শৃঙ্খলের স্থানীয় খুঁটি ও ব্যবস্থাপক। এই বিশ্ব পুঁজিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রাখাই হলো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় তাই আমরা স্থানীয় পুঁজি বা শাসক শ্রেণির বদলে দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক পুঁজি বা আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থার সম্প্রসারিত কার্যক্রম। সেই আন্তর্জাতিক পুঁজির পরিচালন ও মুনাফাবর্ধক হলো বহুজাতিক কোম্পানি। তার ব্যবস্থাপক ও পাহারাদার হিসেবে আবির্ভুত হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও ন্যাটোসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের। স্থানীয় পুঁজবাদী তৎপরতার মতোই স্থানীয় শাসকরা এই বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি ও বিশ্ব বুর্জোয়ারই শরীক বা লেজুড়। বাংলাদেশের শাসকশেধণী শাসনব্যবস্থা এই বিশ্ব শাসক তথা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জায়ারই অনুগত লেজুড় ও পদলেহনকারী ভৃত্য। ঔপনিবেশিকতার গর্ভে জন্ম নেয়া মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার এভাবে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত দাসে পরিণত হওয়া হলো তার ঐতিহাসিক পরিণতি।
অন্যদিকে উনিশ শতকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভেতর দিয়ে লুণ্ঠনের যে কার্যক্রম গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল তা এখন আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে জমি, নদী, অরণ্য ও খনিজ লুণ্ঠনের মাধ্য̈মে চূড়ান্তে পৌঁছেছে। ঔপনিবেশিক ভারত তথা বাংলায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় ̄স্বার্থের রাজনীতি আজ তার অন্তিমদশায় কর্মসূচিহীন হয়ে পড়েছে। ফলতঃ সন্ত্রাস ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থাপনা হয়ে পড়েছে এদেশীয় শাসকদের একমাত্র কর্মসূচি।
নারী ও পরিবেশকে কখনো ভোগ কখনো মুনাফার উদ্দেশ্যে নির্মাণ ও বিকৃতকরণ ও পণ্যে রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা আজ পর্ণোগ্রাফি, নারীবাণিজ্য, সৌন্দর্যবাণিজ্য, এবং পরিবেশকে টিভি চ্যানেলে প্রদর্শন, চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্য ইত্যাদির মাধ্য̈মে কৃত্রিম সংরক্ষণের আড়ালে জীব ও প্রকৃতির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক বণিকদের অগ্রবাহিনী ধর্মীয় মিশনারীদের বদলে এখন আমাদের সামনে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক বাহিনী এবং অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক হিসেবে এনজিওকে একই সাথে রাজনৈতিক দল, অর্থশোষণ যন্ত্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার কেন্দ্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, বিশেষত শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র এই বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতেরই অংশ, পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতির অনিবার্য ফলাফল। সে কারণে শিক্ষার চেতনার মধ্যে স্বাধীন চিন্তার শর্ত অনুপস্থিত, সমাজের প্রয়োজন-জনগণের স্বার্থ এখানে অবাঞ্ছিত ও পরিত্যক্ত। ছাত্রদের তৎপরতা সুতরাং আধিপত্যবাদী ধারারই অনুগত। ছাত্র আন্দোলন কর্মসূচীহীন বুর্জোয়াদের লেজুড় হয়ে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে অপারগ। অন্য̈দিকে প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন বিপ্লবী চিন্তাগত ও ব্যবহারিক চর্চার অভাবে পূর্বে বর্ণিত ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত ও বিমোধন না করে পরিস্থিতির এই নৈরাজ্যি̈ক অথচ অক্ষম তৎপরতার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সুতরাং আমরা কার উত্তরাধিকার সেটা চিহ্নিত করা জরুরি। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মধ্য̈যুগ জুড়ে উত্থিত অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী অভুত্থান, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগার লড়াই, ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের যে উজ্জ্বল রেখা তাকে সম্পসারিত করে আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লড়াই সংগঠিত করতে চাই। বাংলার কৃষক সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক, লড়াকু বাউল-সাধকের লোকপ্রজ্ঞা তথা আমাদের জনসংস্কৃতির মধ্যকার ইহজাগতিক, কান্ডজ্ঞাননির্ভর যুক্তিবাদী চৈতন্য নির্মাণের প্রচেষ্টার সঙ্গে আমাদের মুক্তির দর্শনকে যুক্ত করে দেশজনতার সঙ্গে বৈশ্বিকতার; ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ অংশের সঙ্গে উন্নত ভবিষ্যতের চিন্তাগত প্রস্তুতির কাজের যোগসাধন করতে চাই। সর্বোপরি এযাবৎকালের ছাত্র আন্দোলন যে সমস্ত প্রশ্নকে উপেক্ষা করে এসেছে, বর্তমানের যে সমস্ত নতুন শর্ত ও পরিবর্তনকে সনাক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে, সেসবকে গুরত্ব দিয়েই আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সাংগঠনকি কর্মকান্ডকে পুনঃসজ্জিত করতে চাই। আর তাই শিক্ষার বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষার আঙিনা থেকে পরিত্যক্ত ও ঠেকিয়ে রাখা কোটি কোটি শিশুদের কথা বলি। শিক্ষানীতির দাবি তুলতে গিয়ে ছদ্মবিজ্ঞান, বিশেষায়িতকরণের নামে খণ্ডিতকরণ, পরষ্পরবিরোধী উপাদানে ভরা সিলেবাসের সমালোচনা করি। আমাদের সমাজের আশু প্রয়োজানের সাথে মিলিয়েই শিক্ষার প্রশ্নকে উত্থাপন করি। যে শিক্ষা নীতি এমন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক কায়দায় পরিপালিত হবে। যাতে শিক্ষিতকরণের নামে জনগণ সম্পর্কে অবজ্ঞা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিবর্তে; ডিগ্রিধারী কুপমুণ্ডক অকর্মণ্য পেশাজীবী তৈরির বিপরীতে সমাজ বিনির্মাণের কাজে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত জনগণের তথা মেহনতি মানুষের মুক্তির সহযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মী তৈরি করা যায়। যে কর্মীরা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী প্রচার জালের তথ্য সন্ত্রাস ও তথ্য গুম করার কৌশলী কার্যক্রমকে ভেঙ্গে ফেলবে। শোষণের সহায়ক মতাদর্শের আধিপত্য̈কে পাল্টা মতাদর্শিক হাতিয়ার দ্বারা চূর্ণ করে জনগণের মুক্তির দর্শনকে, তা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রমকে পরিপুষ্ট করবে। তথ্য ও চিন্তা তথা জ্ঞানের ক্ষমতা প্রদর্শন রোখাকে বা জ্ঞানের ওপর মালিকানা উচ্ছেদের দাবিকে সম্পদের ওপর মালিকানা উচ্ছেদের আন্দোলনের সহযোগী করতে পরিচালনা করতে হবে।
আমাদের সমাজ যেহেতু কোনো গণ্ডিবদ্ধ ও আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, তা বিশ্বের জনগণ ও বিশ্ব পরিস্থিতিরই অংশ, সে কারণে আমরা আমাদের লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক তাৎপর্যকে ভুলি না। যেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, উপরন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পূর্বের বিশ্লেষণ থেকে যখন দেখতে পাচ্ছি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমের আধিপত্য প্রবলভাবে বিরাজমান, তখন শিক্ষার আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী হতে বাধ্য। তার দেশীয় প্রতিনিধি হিসেবে দেশীয় শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে বাধ্য।
আমরা যাকে সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা বলে জানি আর প্রকৃত সাংস্কৃতিক তৎপরতা যে উৎস থেকে পরিচালিত হয়, তা এক নয়। গোটা সমাজের সাংস্কৃতিক জীবন যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যে প্রকার শর্তের আওতায় তা গঠিত হয় তা আসে সাংস্কৃতিক তৎপরতার চেয়েও শক্তিশালী কোনো বাস্তবতা থেকে সামজের অর্থনৈতিক পুনরুৎপাদন কার্যাবলীই হলো সেই ভিত্তি যার সমর্থনে ও নিয়ন্ত্রণে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন সঞ্চালিত হয়-নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। আমাদের দেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও আশু পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার সর্বত্রই যখন চাহিদা মাফিক উৎপাদন নেই, ̄স্বাবলম্বী ও সুস্থ জীবনের জন্য আবশ্যক পুনরুৎপাদন নেই, তখন সাংস্কৃতি ক্ষেত্রেও তার অনিবার্যভাবেই অনুপস্থিত থাকবে। নিজস্ব উৎপাদনী ক্ষমতার ওপর না দাঁড়ানোর ̄স্বাভাবিক পরিণতি হলো অন্যের দ্বারস্থ হওয়া, উর্দ্ধতনের ওপর নির্ভরশীল থাকা। এই নির্ভরতা ও মুখাপেক্ষিতা যে মানসলোক গঠন করে তার ভেতরও উপরোক্ত চরিত্র প্রকাশিত হবে-সন্দেহ নাই। বৈষয়িক ক্ষেত্রে যে কায়দায় অধিক পরিণত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে, যার সূত্রে সেই দেশসমূহের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ দেশীয় শাসক শ্রেণিকেও অঙ্গীভূত করেছে তাতে করে এই ব্যবস্থা অটুট রেখে স্বাধীন রাষ্ট্র ও মুক্তসমাজ নির্মাণ একটি অবাস্তব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
উপরন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লুণ্ঠন তৎপরতার ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার কারণে জনজীবনে ব্যাপক নৈরাজ্য̈ ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। বর্তমান কালে এদেশের অধিকাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন ওই বাস্তব অবস্থার আবর্তিত হচ্ছে। একটি দেশের সাংস্কৃতিতে প্রধানত সে দেশের শাসকদের প্রাধন্য থাকে। মধ্য শ্রেণি সেই সাংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে শাসকশেধণীর স্বার্থকে জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের বুর্জোয়া বিকাশ অপরিণত ও পঙ্গু হবার কারণে সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেউলিয়া চরিত্র সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। সমাজ বিকাশের কোনো চিন্তার প্রতিনিধিত্ব তাই আর এদের দ্বারা বা এদের সাথে সম্পর্কিত মধ্যশ্রেণির কাতারভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ শাসকদের তরফ থেকে সুবধাভোগী এইসব বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবই বাংলাদেশের জনগণের চিন্তাকাঠামোর তথা সাধারণভাবে তরুণ শিক্ষর্থীদের মস্তিষ্ক দখল করে আছে। নিজেদের জীবনের বাস্তব সমস্যার সাথে, জগৎ সম্পর্কে কোনো সৃষ্টিশীল গভীরে বোধের সাথে এদের সম্পর্ক না থাকার কারণে কী সাংস্কৃতি কী জীবন কোথাও কোনো উন্নতি সাধন সম্ভব হচ্ছে না। তরুণদের যে অংশটি বিচ্ছিন্নভাবে বেরিয়ে আসতে তৎপর, তাদের প্রচেষ্টাও সমাজের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে কাজ করতে বা তা সম্পর্কে কোনো সার্বিক রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত হতে অনীহা। তাতে করে অচলাবস্থা পরিবর্তনের জন্য যে বৃহৎ কর্মোদ্দীপনা সক্রিয়তা দরকার তা জন্ম নিতে পারছে না। এদেশের সমাজ বিকাশের ধারা নানা আর্থ-সামাজিক কারণে বারবার বিপর্যস্ত ও ব্যাহত হয়েছে। তরুণদের ব্যাপক অংশ পূর্বসূরীদের দিক থেকে কোনো পথনির্দেশ, সফল দৃষ্টান্ত বা দায়বদ্ধতা চর্চার অভিজ্ঞতার মধ্যে না থাকার ফল হিসেবে নিজেদের জীবনে সেসবের প্রয়োগ করতে উৎসাহিত হয় নি। বরং শাসক শ্রেণির লুম্পেন চরিত্র, নিজেদের জীবনের অনিশ্চয়তা প্রভৃতি দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের বৃত্তে আটকে থাকছে। তার মানস জীবন ও জীবন অভ্যাস হয়ে পড়েছে বিশৃঙ্খল, উদ্দেশ্যহীন ও হতাশাগ্রস্ততার নির্মম নজির।
এই রকম অসুস্থ ও দিশাহীন আবহের মধ্যে থেকে স্বাভাবিক-স্বতঃফূর্ত-সবল কোনো রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক ধারা বেড়ে উঠতে পারে না। তরুণদের সাংগঠনিক সমষ্টিবদ্ধতার প্রক্রিয়াও সবল ভিত্তির ওপর ধারাবাহিকতার মধ্যে পরিচালিত হতে পারে না। চিন্তা কাঠামো বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ ও সজীব উপাদানে শক্তিশালী হতে পারে না। ফলে যা হয় তা হলো, তরুণদের ব্যাক্তিত্ব্য হলো অসামাজিক ও দায়হীন। তাদের চিন্তা নিজেদের জীবন জগৎকে বুঝতে অক্ষম হয় বা কিছুদূর বুঝলেও তাকে পাল্টাতে নিরুৎসাহী হয়ে থাকে। অর্থাৎ চিন্তা ও কর্মের মধ্যে বিস্তর ফারাক দাঁড়িয়ে যায়। হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্নতার শিকার। এই বিচ্ছিন্নতার দুটো দিক আছে। প্রথমত, তা নিজ শ্রেণি বা বর্গ থেকে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, তা জনগণের ব্যাপক অংশ থেকেও বিমুখ করে রাখে। এই হতাশা এই বিচ্ছিন্নতা এই নৈরাশ্য থেকেই সে সন্ত্রসী হয় অথবা সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত হয়। মাদক ও যৌন ব্যবসার মাধ্য̈ম বা লক্ষ্য̈বস্তুতে পর্যবসিত হয়। হয়ে উঠে শাসক-সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণজালের ক্রীড়ানক। তখন ব্যাক্তিকেন্দ্রীকতার গহ্বরে আটকে থেকে অসহায়-অসংগঠিত ক্রোধ প্রকাশে কিংবা আক্ষেপ হাহাকারের মধ্যেই তার সমস্ত শক্তি, সমস্ত সক্রিয়তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই অবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষে মানুষে ভাঙ্গন।
একটি সমাজ যখন বিদ্যমান সমাজের মধ্যে মীমাংসাতীত সংকটে পড়ে তখন তার প্রথম এবং সর্বোচ্চ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় সামজিক সম্পর্কের ভাঙ্গনের মধ্যে, সম্পর্কের আদল পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে। মানুষ তখন পরিচিত সম্পর্কের প্রতি তা যতই পবিত্র, আস্থাশীল, প্রয়োজনীয় কিংবা ব্যবহারিক বলে মনে হোক, তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে, পাল্টাতে চায়। এই চাপ থেকেই তৈরি হওয়া সম্ভব নতুন সমাজের অগ্রসর মানবিক সম্পর্ক। কিন্তু সেই চেষ্টা যখন দূর্বল থাকে, তার পথ ও প্রক্রিয়া যখন অস্পষ্ট থাকে তখন বিকৃতির জন্ম হয়। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষে, আত্মীয়-পরিজনে, শাসক-শাসিতে, ভাব-কাজে এবং চূড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কে এই ভাঙ্গন এবং তৎজনিত ক্ষোভ-বিকার এখন আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এটা হলো পরিস্থিতির ক্ষয়ের দিক, হতাশার দিক। কিন্তু একটু গভীরভাবে নজর দিলেই বোঝা যাবে এবং যাচ্ছে যে, এই ক্ষয় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা এবং তার মতাদর্শের ক্ষয়। এই হতাশা বর্তমানে যেভাবে জীবন যাপন চলছে, যে ক্ষমতা কাঠামো এভাবে চলতে বাধ্য করছে তার সম্পর্কে হতাশা। যে প্রতিবাদ কোনো লক্ষ্য না পেয়ে সন্ত্রাসের দিকে যাচ্ছে, আত্মধ্বংসী আসক্তির দিকে ঝুঁকছে তার প্রকৃত ও অনিবার্য লক্ষ হলো, যেখানে সমস্যার কারণ সেখানে আঘাত করা, তাকে পাল্টানো এবং উন্নত জীবন ও তার ভাবাদর্শিক আয়োজনকে সংগঠিত করা। এই কাজের অপরিহার্যতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি করে আমাদের সামনে উপস্থিত। কেননা অসন্তোষের পথ ধরে পুরো সমাজের মধ্যে তো বটেই, এমনকি সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার অগ্রণী অংশের মধ্যে ভিন্নমত ও বিরোধী চিন্তার উন্মেষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর জন্ম এই সামাজিক অসন্তোষের ভেতরে, তৎজাত ভিন্নমত-বিরোধী চিন্তা এবং প্রতিবাদী তৎপরতার গর্ভে। এই চিন্তা ও তৎপরতাকে আমরা আমাদের সাধ্য̈মত বিকশিত করেছি, করবার চেষ্টা করেছি। সেই প্রয়োজনেই ছাত্র সমাজের মধ্যে নবীন বিদ্বৎ সমাজের মধ্যে যে শারীরিক প্রতিরোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের বাস্তব শর্ত তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র ও অঙ্গনে তার যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভব দেখা দিচ্ছে তার সঙ্গে আমরা আমাদের উদ্যোগ ও আয়োজনকে যুক্ত করতে চাই। একত্রিত হয়ে লড়াইয়ের উপাদানকে, প্রতিরোধের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে অভিন্ন শত্রুর সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে চাই। কেবল এর মাধ্যমেই সম্ভব পরিস্থিতির এই জটিল ও হতাশাজনক চিত্রকে ঢেকে দিয়ে, অচলতার জলাশয়ে স্রোত সৃষ্টি করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তো বটেই ছাত্র সমাজের মানসলোককে উজ্জীবিত-সুসংগঠিত ও বিকাশমুখী করা। এই সম্ভাব্যতাই হোক এই মুহূর্তে পরিবর্তনের চেষ্টার বাস্তব চালিকাশক্তি।
এদেশের বিপ্লবী আন্দোলন যখন পরিবেশ আন্দোলন, নারীমুক্তির আন্দোলন, জাতিগত-নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনকে উপেক্ষা কিংবা তার যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনের ব্যার্থ হচ্ছে তখন আমরা আমাদের কর্মসূচী ও রাজনৈতিক শিক্ষার মধ্যে উপরোক্ত ইস্যুগুলোকে মৌলিক গুরুত্ব দিয়েই পরিচালিত করতে চাই। কেননা যা কিছু মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত, যা কিছু সমাজের মৌলিক অংশ এবং যা কিছু লুটেরা সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ-নির্যাতনের শিকার তার সবই আমাদের আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত। তার সবকিছুকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে কোনো প্রকৃত মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। সেকারণে নারী পরিবেশ জাতি প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের শিক্ষা আন্দোলন তথা বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বলে মনে করি। এবং সেই চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি। তরুণ ছাত্ররা সমাজের সেই অংশ যারা এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হন। শিক্ষার্থী হিসেবে, নবীন বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মী হিসেবে এ সব প্রশ্নের মোকাবেলা না করলে, ছাত্র আন্দোলনের এইসব প্রতিবন্ধকের ফয়সালা না হলে শুধু ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র সংগঠন কেন কোনো অগ্রসর চিন্তা, অগ্রবর্তী পদক্ষেপ কী রাজনীতি কী সাংস্কৃতি কী ব্যাক্তিত্ব নির্মাণ কোনো ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। একই কারণে সংগঠন বিকাশ কিংবা প্রতিবাদ- প্রতিরোধ প্রচেষ্টা, সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি কিংবা এবং সংগঠনের ব্যবহারিক সাংস্কৃতির মধ্যে পূর্বোল্লেখিত পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে রাজনীতি হবে সংগঠন হবে আন্দোলন হবে কিন্তু সেই রাজনীতি সেই
সংগঠন সেই আন্দোলন বুর্জোয়া রাজনীতির বিষাক্ত বৃত্ত ছিন্ন করে, অগণতান্ত্রিক, অবৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি পরিহার করে, ছাত্রদের বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণ শৃঙ্খল ভঙ্গ করা তো আকাশকুসুম, নিজেদের সামান্য̈তম বিকাশ সাধনেও ব্যর্থ হবে। আমাদের পথের এই সব বাধা চিন্তার এই সব ক্ষয় রোধ করে নতুন যুগের নতুন কাজ গড়ে তুলে শিক্ষা- সাংস্কৃতি ও মানবিক মূল্য̈বোধের বিনির্মাণের মাধ্য̈মে শ্রমিক শ্রেণির সহায়ক ছাত্র আন্দোলন দাঁড় করানো এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক দায়। সেই দায় মেটাতে পারে বুর্জোয়া প্রবণতামুক্ত, তা থেকে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা অহমিকা জটিলতামুক্ত নতুন ধরনের কর্মী, সংগঠক, প্রতিবাদী ব্যাক্তিত্বরা। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন সেই কর্মী তৈরির পাঠশালা; সেই কর্মকাণ্ডেরই উদ্বোধক।
একটি ̄স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭১ সালে। সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পূর্ব-বাংলা বেরিয়ে এসে পাকিস্তানিদের পরিবর্তে বাঙালীদের শাসন কায়েম করলে ও জনগণের স্বাধীনতা ও নিপীড়ন মুক্তির কোনো গণতান্ত্রিক আকাংক্ষাই এই রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হয় নি। এর কারণ নিহিত আছে শোষকদের জাতিগত চরিত্র পাল্টালেও যে শ্রেণির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তার ঐতিহাসিক গঠন ও শ্রেণির চরিত্রের মধ্যে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের যে অংশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছিল তারা মোটেই রাজনৈতিক স্বাধীন ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ছিল না। তাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি প্রোথিত ছিল ঔপনিবেশিক কাঠামোয় বেড়ে ওঠা অনুৎপাদক মুৎসুদ্দির সুবিধাবাদী ও গণবিচ্ছিন্নতার মধ্যে কেননা তারা ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রয়োজনে সৃষ্ট দেশীয় মুৎসুদ্দিদেরই বিশ শতকীয় সংস্করণ। এই অবস্থায় ব্যাখ্যা ব্রিটিশ-ভারত তথা বাংলা সমাজ বিকাশে ধারার পর্যালোচনা থেকে।
ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতীয় সামন্ত সমাজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল কিন্তু সে পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ শর্তের ও তার শক্তিতে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলো ইংরেজ শাসন, তা কার্যতঃ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশে পরিণত হলো। ফলে ভারতের স্বাভাবিক বিকাশধারা স্থায়ীভাবে বাধাগ্রস্থ হলো। তারপর থেকে এই ভূখন্ডের জনজীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামজিক আন্দোলন সব কিছুর ওপরই উপনিবেশিক শাসকদের আধিপত্য বজায় থাকলো। সেই আধিপত্বের প্রভাবেই এখানে যা কিছু হতে থাকলো তার উদ্দেশ্য ইউরোপিয় বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার আয়োজনকে অব্যহত রাখা। তার দেশীয় প্রতিনিধিদের রক্ষা ও প্রতিপত্তিময় করে তোলা।
এর ঐতিহাসিক পরিণতিতে এখানে বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো। কিন্তু সেই সংস্কৃতি অন্তসারশূণ্য, নিঃশর্ত আনুগত্যের ও বন্ধ্যা চরিত্রের। এখানে উন্নয়নের নামে অনেক কিছু করা হলো কিন্তু উন্নয়ন শাসকদের যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু তাও আবার জনগণের প্রয়োজন ও ঐতিহাসিকতার অর্জনকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে। এখানে শিক্ষাদীক্ষায় আধুনিকতা প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু সেই শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির মানসলোক হলো উচ্চমন্য। আধুনিকতা জনগণের অভিজ্ঞতা, জনগণের ঐতিহ্যিক ভাবসম্পদকে অবজ্ঞা করলো, তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলো। এখানে রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিবাদ ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত প্রতিষ্ঠা হলো ঠিকই কিন্তু তা জনগণের সংগ্রামের লক্ষ্য সর্বোপরি গণস্বার্থকে বিবেচনা করলো না। কৃত্রিমভাবে গ্রহণ করলো ইউরোপিয় বুর্জায়াদের কায়দা-কানুন ও আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের প্রকরণ। এখানে সমাজ সংস্কারের জোয়ার দেখা গেল। উনিশ শতকীয় জোব্বা পরিহিত মহাপুরুষরা জাতিকে উদ্ধার করতে নামলেন কিন্তু তার মধ্যে নিহিত ছিল জনগণের প্রতি অশ্রদ্ধা, বিদেশী মতের নির্ভরতা। উপরন্তু তা ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, আভিজাত্য ইত্যাদি প্রশ্নকে যথাযথভাবে ফয়সালা করতে না পারার কারণে রাজনৈতিক চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধার্মিকতার প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত করলো।
এই অবস্থার বিপরীতে নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী ও কৃষক জনগণ প্রতিবাদ, অর্ভ্যূথান, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে গেছেন। যদিও লড়াইয়ের এই ধারা এমনভাবে বিকশিত হতে পারেনি যাতে করে ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রভাবে বেড়ে ওঠা বুর্জোয়া সংস্কৃতির এবং মধ্যবিত্তের গষ্ঠিবদ্ধ রাজনীতিকে নাকচ করে নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যতকে মুক্ত করার দিকে আগুয়ান থাকতে পারে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত থেকে আগত বিপ্লবী এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক ধারা উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে মীমাংসায় অপারগ ও উদাসীন থাকার কারণে প্রতিবাদী আন্দোলনের ধারা প্রথম থেকেই দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে চলতে থাকলো।
এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বাধীন রাজনীতি দেশকে বিভক্ত না করে নিজেদের শাসন কায়েম করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার ছাড়া জনগণের মধ্যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তাই ’৪৭-এর দেশ ভঙ্গের কেন্দ্রে থাকে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো প্রবল সাম্প্রদায়িক বিবেচনা। যা কার্যতঃ জনগণের সাথে শাসকশ্রেণির ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
যদিও দেশ ভাগের প্ররোচনা ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যে, তবুও ’৪৭ এর পর পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো বস্তুগত ভিত্তি আর রইল না। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন বিরোধী সম্প্রদায়। সেই হিন্দু সম্প্রদায় দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের নিপীড়ন ইত্যাদির কারণে বিতাড়িত হবার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলমানদের একক আধিপত্য। সেই আধিপত্যের মুখে অবশিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায় এতই ক্ষুদ্র ও দুর্বল যে তাকে দেখিয়ে এখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। এটাই হলো সেই কারণ, যে কারণে মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক দল এখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়। গঠিত অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি। সেই ভিত্তির মধ্যে যতটুকু সাম্প্রদায়িক অবশেষ ছিল তা-ও দুর্বল হয়ে যায় ভাষা আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে। ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতাকে দুর্বল করলেও শক্তিশালী করলো পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সম্ভাবনাকে।
কিন্তু উপনিবেশ প্রতিপালিত মধ্যবিত্ত স্বাধীনতা পেলেও সাংস্কৃতিকভাবে হীনমন্য, অর্থনীতি বিস্তারে পঙ্গু, রাজনৈতিকভাবে গণবিরোধী হবার কারণে তার দ্বারা কোনো সুস্থ জাতীয়তার বিকাশ ঘটলো না, ঘটলো একদিকে উগ্র জাতীয়তা, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের নির্ভরতার বিকাশ। যে ’৭১-এর পরে এই মধ্যবিত্ত যখন পূর্ণ শাসনক্ষমতা পেল, তখন তাদের এই উগ্র জাতীয়তা রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদ এবং অর্থনৈতিকভাবে লুন্ঠন তৎপরতায় নিয়োজিত হলো। ভেতরে তখনও রয়ে গেল সাম্পধদায়িকতা ও জাতি বিদ্বেষের সূত্র প্রভাব।
এর বিপরীতে বিপ্লবী আন্দোলনও তার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা না করে একমুখে নৈরাজ্যিক অন্য মুখে সুবিধাবাদী লেজুড়পনার দোলাচলে বন্দী থাকলো। সংগঠনের রাজনৈতিক তৎপরতা জনগণের সাথে সম্পর্ক ও নিজেদের ইতিহাস প্রভৃতিকে নির্মোহ দ্বাদ্বিক বিশ্লেষণে দেখতে পারার পরিবর্তে বুর্জোয়া প্রবনতা, মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা ও ইউরোপ-রাশিয়া-চীন প্রভৃতির প্রতি আনুগত্যের মধ্যে ভরসা খুঁজতে ব্যস্ত রইলেন। যাতে করে জনগন, শ্রমিক শ্রেনি ও তার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সাথে বিপ্লবী আয়োজনের কোনো সেতু রচিত হলো না বরং দিনে দিনে সেই সেতু আরও ভেঙ্গে গিয়ে চিন্তাগতভাবে উদ্দেশ্যহীন, নাবালকসুলভ এবং সাংগঠনিকভাবে অথর্বই হয়ে থাকল।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনও এর শিকার, এর দুর্বলতার প্রভাবাধীন। বিপ্লবী রাজনীতির নামে যখন মধ্যবিত্তের প্রাধন্যই কর্মসূচি ও নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেই রাজনীতি শাসক বুর্জোয়ার ভূয়া জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের মধ্যে আটকে থাকে, সেই বিপ্লব জনগণের প্রকৃত স্বার্থকে ধারণ করতে পারে না। উপরন্তু শাসক শ্রেণির কর্মসূচির পেছনেই শামিল হয়। তখন এই ধরনের তৎপরতা থেকে বিপ্লবীধারার ছাত্র আন্দোলন যে বিকশিত হতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে মূল রাজনীতির মতো ছাত্র রাজনীতিও প্রতিক্রিয়া নির্ভর থেকে গেছে। অর্থাৎ শাসক রাষ্ট্রের কোনো না কোনো কর্মকান্ডের প্রতিবাদ-বিরোধিতার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। নিজেদের দিক থেকে কী বৃহৎ রাজনীতি থেকে কী ছাত্র রাজনীতি কোথাও ̄স্বতন্ত্র অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে এমন কর্মসূচি দেখা যায়নি। আমাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে এ সত্য প্রমাণিত হবে। তেভাগা আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যূত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর নাগরিক গণ অভ্যূত্থান প্রভৃতি ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রত্যেকটিতেই অংশগ্রহণ করেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিন্তু কর্মসূচি এমনভাবে দেখিয়েছে যে, সেই চেষ্টা-উদ্যোগ-পরিশ্রম ও রক্তক্ষয় থেকে ফায়দা লুটেছে জনগণের শত্রুরা। এরই ফলশ্রুতি বাংলাদেশে বুর্জোয়াদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন এদিক থেকে অগ্রসর হলেও এর অর্জনও ছিনতাই হয়ে গেছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত অংশ হিসেবে বুর্জোয়াদের ওপর থেকে শ্রেণির আনুগত্য পরিহার করে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির অধিন্যস্ত না হবার কারণেও আন্দোলন সংগ্রাম ভেতর থেকেই দুর্বল রয়ে গেছে। সংগঠনে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদিতা-আপোষকামিতা ও নৈরাজ্যবাদী আচরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোট কথা প্রতিক্রিয়া জায়গায় ক্রিয়া করা, শাসক-কর্তার লুণ্ঠন শাসনের মাধ্যমে বা বৈধতা দানকারী না হয়ে নিজেরাই কর্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করা, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সহায়ক লক্ষ্য কাজ চেষ্টা থেকে আমাদের ছাত্র আন্দোলন সর্বদাই পিছিয়ে ছিল। ছাত্র কোনো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শ্রেণি নয়। বরং তারা এরকমই কোনো শ্রেণির অংশ। মধ্যবিত্তের ভেতরেই তার বসবাস, তার চিন্তার বিকাশ। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেও কোনো মৌলিক শ্রেণি নয়। গঠনের দিক থেকে নির্ভরশীলতার বিচারে মধ্যশ্রেণি মালিক বুর্জোয়ারই সহযোগী-তারই অনুগত। সে কারণেই রাজনীতিগতভাবে আনুগত্যের এই বন্ধন ছিন্ন না করে, শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শকে ধারণ না করে কী সমাজ কী নিজেদের বর্গ-কারুরই অগ্রগতি সাধন হতে পারে না। ছাত্র সমাজের মুক্তির লড়াই তাই আমাদের কালে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির লড়াইয়ের সহযোগী হয়ে উঠতে বাধ্য।
অন্যদিকে বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। গত কয়েক দশক ব্যাপি পুঁজিবাদ আরও বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে, পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে ব্যাপকভাবে। দেশীয় রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী শৃঙ্খলের স্থানীয় খুঁটি ও ব্যবস্থাপক। এই বিশ্ব পুঁজিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রাখাই হলো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় তাই আমরা স্থানীয় পুঁজি বা শাসক শ্রেণির বদলে দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক পুঁজি বা আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থার সম্প্রসারিত কার্যক্রম। সেই আন্তর্জাতিক পুঁজির পরিচালন ও মুনাফাবর্ধক হলো বহুজাতিক কোম্পানি। তার ব্যবস্থাপক ও পাহারাদার হিসেবে আবির্ভুত হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও ন্যাটোসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের। স্থানীয় পুঁজবাদী তৎপরতার মতোই স্থানীয় শাসকরা এই বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি ও বিশ্ব বুর্জোয়ারই শরীক বা লেজুড়। বাংলাদেশের শাসকশেধণী শাসনব্যবস্থা এই বিশ্ব শাসক তথা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জায়ারই অনুগত লেজুড় ও পদলেহনকারী ভৃত্য। ঔপনিবেশিকতার গর্ভে জন্ম নেয়া মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার এভাবে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত দাসে পরিণত হওয়া হলো তার ঐতিহাসিক পরিণতি।
অন্যদিকে উনিশ শতকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভেতর দিয়ে লুণ্ঠনের যে কার্যক্রম গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল তা এখন আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে জমি, নদী, অরণ্য ও খনিজ লুণ্ঠনের মাধ্যমে চূড়ান্তে পৌঁছেছে। ঔপনিবেশিক ভারত তথা বাংলায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় ̄স্বার্থের রাজনীতি আজ তার অন্তিমদশায় কর্মসূচিহীন হয়ে পড়েছে। ফলতঃ সন্ত্রাস ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থাপনা হয়ে পড়েছে এদেশীয় শাসকদের একমাত্র কর্মসূচি।
নারী ও পরিবেশকে কখনো ভোগ কখনো মুনাফার উদ্দেশ্যে নির্মাণ ও বিকৃতকরণ ও পণ্যে রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা আজ পর্ণোগ্রাফি, নারীবাণিজ্য, সৌন্দর্যবাণিজ্য, এবং পরিবেশকে টিভি চ্যানেলে প্রদর্শন, চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্য ইত্যাদির মাধ্যমে কৃত্রিম সংরক্ষণের আড়ালে জীব ও প্রকৃতির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক বণিকদের অগ্রবাহিনী ধর্মীয় মিশনারীদের বদলে এখন আমাদের সামনে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক বাহিনী এবং অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক হিসেবে এনজিওকে একই সাথে রাজনৈতিক দল, অর্থশোষণ যন্ত্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার কেন্দ্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, বিশেষত শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র এই বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতেরই অংশ, পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতির অনিবার্য ফলাফল। সে কারণে শিক্ষার চেতনার মধ্যে স্বাধীন চিন্তার শর্ত অনুপস্থিত, সমাজের প্রয়োজন-জনগণের স্বার্থ এখানে অবাঞ্ছিত ও পরিত্যক্ত। ছাত্রদের তৎপরতা সুতরাং আধিপত্যবাদী ধারারই অনুগত। ছাত্র আন্দোলন কর্মসূচীহীন বুর্জোয়াদের লেজুড় হয়ে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে অপারগ। অন্যদিকে প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন বিপ্লবী চিন্তাগত ও ব্যবহারিক চর্চার অভাবে পূর্বে বর্ণিত ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত ও বিমোধন না করে পরিস্থিতির এই নৈরাজ্যিক অথচ অক্ষম তৎপরতার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সুতরাং আমরা কার উত্তরাধিকার সেটা চিহ্নিত করা জরুরি। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ জুড়ে উত্থিত অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী অভুত্থান, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগার লড়াই, ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের যে উজ্জ্বল রেখা তাকে সম্পসারিত করে আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লড়াই সংগঠিত করতে চাই।
বাংলার কৃষক সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক, লড়াকু বাউল-সাধকের লোকপ্রজ্ঞা তথা আমাদের জনসংস্কৃতির মধ্যকার ইহজাগতিক, কান্ডজ্ঞাননির্ভর যুক্তিবাদী চৈতন্য নির্মাণের প্রচেষ্টার সঙ্গে আমাদের মুক্তির দর্শনকে যুক্ত করে দেশজনতার সঙ্গে বৈশ্বিকতার; ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ অংশের সঙ্গে উন্নত ভবিষ্যতের চিন্তাগত প্রস্তুতির কাজের যোগসাধন করতে চাই। সর্বোপরি এযাবৎকালের ছাত্র আন্দোলন যে সমস্ত প্রশ্নকে উপেক্ষা করে এসেছে, বর্তমানের যে সমস্ত নতুন শর্ত ও পরিবর্তনকে সনাক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে, সেসবকে গুরত্ব দিয়েই আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সাংগঠনকি কর্মকান্ডকে পুনঃসজ্জিত করতে চাই। আর তাই শিক্ষার বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষার আঙিনা থেকে পরিত্যক্ত ও ঠেকিয়ে রাখা কোটি কোটি শিশুদের কথা বলি। শিক্ষানীতির দাবি তুলতে গিয়ে ছদ্মবিজ্ঞান, বিশেষায়িতকরণের নামে খণ্ডিতকরণ, পরষ্পরবিরোধী উপাদানে ভরা সিলেবাসের সমালোচনা করি। আমাদের সমাজের আশু প্রয়োজানের সাথে মিলিয়েই শিক্ষার প্রশ্নকে উত্থাপন করি। যে শিক্ষা নীতি এমন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক কায়দায় পরিপালিত হবে। যাতে শিক্ষিতকরণের নামে জনগণ সম্পর্কে অবজ্ঞা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিবর্তে; ডিগ্রিধারী কুপমুণ্ডক অকর্মণ্য পেশাজীবী তৈরির বিপরীতে সমাজ বিনির্মাণের কাজে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত জনগণের তথা মেহনতি মানুষের মুক্তির সহযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মী তৈরি করা যায়। যে কর্মীরা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী প্রচার জালের তথ্য সন্ত্রাস ও তথ্য গুম করার কৌশলী কার্যক্রমকে ভেঙ্গে ফেলবে। শোষণের সহায়ক মতাদর্শের আধিপত্যকে পাল্টা মতাদর্শিক হাতিয়ার দ্বারা চূর্ণ করে জনগণের মুক্তির দর্শনকে, তা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রমকে পরিপুষ্ট করবে। তথ্য ও চিন্তা তথা জ্ঞানের ক্ষমতা প্রদর্শন রোখাকে বা জ্ঞানের ওপর মালিকানা উচ্ছেদের দাবিকে সম্পদের ওপর মালিকানা উচ্ছেদের আন্দোলনের সহযোগী করতে পরিচালনা করতে হবে।
আমাদের সমাজ যেহেতু কোনো গণ্ডিবদ্ধ ও আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, তা বিশ্বের জনগণ ও বিশ্ব পরিস্থিতিরই অংশ, সে কারণে আমরা আমাদের লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক তাৎপর্যকে ভুলি না। যেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, উপরন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পূর্বের বিশ্লেষণ থেকে যখন দেখতে পাচ্ছি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমের আধিপত্য প্রবলভাবে বিরাজমান, তখন শিক্ষার আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী হতে বাধ্য। তার দেশীয় প্রতিনিধি হিসেবে দেশীয় শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে বাধ্য।
আমরা যাকে সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা বলে জানি আর প্রকৃত সাংস্কৃতিক তৎপরতা যে উৎস থেকে পরিচালিত হয়, তা এক নয়। গোটা সমাজের সাংস্কৃতিক জীবন যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যে প্রকার শর্তের আওতায় তা গঠিত হয় তা আসে সাংস্কৃতিক তৎপরতার চেয়েও শক্তিশালী কোনো বাস্তবতা থেকে সামজের অর্থনৈতিক পুনরুৎপাদন কার্যাবলীই হলো সেই ভিত্তি যার সমর্থনে ও নিয়ন্ত্রণে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন সঞ্চালিত হয়-নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। আমাদের দেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও আশু পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার সর্বত্রই যখন চাহিদা মাফিক উৎপাদন নেই, ̄স্বাবলম্বী ও সুস্থ জীবনের জন্য আবশ্যক পুনরুৎপাদন নেই, তখন সাংস্কৃতি ক্ষেত্রেও তার অনিবার্যভাবেই অনুপস্থিত থাকবে। নিজস্ব উৎপাদনী ক্ষমতার ওপর না দাঁড়ানোর ̄স্বাভাবিক পরিণতি হলো অন্যের দ্বারস্থ হওয়া, উর্দ্ধতনের ওপর নির্ভরশীল থাকা। এই নির্ভরতা ও মুখাপেক্ষিতা যে মানসলোক গঠন করে তার ভেতরও উপরোক্ত চরিত্র প্রকাশিত হবে-সন্দেহ নাই। বৈষয়িক ক্ষেত্রে যে কায়দায় অধিক পরিণত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে, যার সূত্রে সেই দেশসমূহের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ দেশীয় শাসক শ্রেণিকেও অঙ্গীভূত করেছে তাতে করে এই ব্যবস্থা অটুট রেখে স্বাধীন রাষ্ট্র ও মুক্তসমাজ নির্মাণ একটি অবাস্তব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
উপরন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লুণ্ঠন তৎপরতার ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার কারণে জনজীবনে ব্যাপক নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। বর্তমান কালে এদেশের অধিকাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন ওই বাস্তব অবস্থার আবর্তিত হচ্ছে। একটি দেশের সাংস্কৃতিতে প্রধানত সে দেশের শাসকদের প্রাধন্য থাকে। মধ্য শ্রেণি সেই সাংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে শাসকশেধণীর স্বার্থকে জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের বুর্জোয়া বিকাশ অপরিণত ও পঙ্গু হবার কারণে সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেউলিয়া চরিত্র সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। সমাজ বিকাশের কোনো চিন্তার প্রতিনিধিত্ব তাই আর এদের দ্বারা বা এদের সাথে সম্পর্কিত মধ্যশ্রেণির কাতারভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ শাসকদের তরফ থেকে সুবধাভোগী এইসব বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবই বাংলাদেশের জনগণের চিন্তাকাঠামোর তথা সাধারণভাবে তরুণ শিক্ষর্থীদের মস্তিষ্ক দখল করে আছে। নিজেদের জীবনের বাস্তব সমস্যার সাথে, জগৎ সম্পর্কে কোনো সৃষ্টিশীল গভীরে বোধের সাথে এদের সম্পর্ক না থাকার কারণে কী সাংস্কৃতি কী জীবন কোথাও কোনো উন্নতি সাধন সম্ভব হচ্ছে না। তরুণদের যে অংশটি বিচ্ছিন্নভাবে বেরিয়ে আসতে তৎপর, তাদের প্রচেষ্টাও সমাজের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে কাজ করতে বা তা সম্পর্কে কোনো সার্বিক রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত হতে অনীহা। তাতে করে অচলাবস্থা পরিবর্তনের জন্য যে বৃহৎ কর্মোদ্দীপনা সক্রিয়তা দরকার তা জন্ম নিতে পারছে না। এদেশের সমাজ বিকাশের ধারা নানা আর্থ-সামাজিক কারণে বারবার বিপর্যস্ত ও ব্যাহত হয়েছে। তরুণদের ব্যাপক অংশ পূর্বসূরীদের দিক থেকে কোনো পথনির্দেশ, সফল দৃষ্টান্ত বা দায়বদ্ধতা চর্চার অভিজ্ঞতার মধ্যে না থাকার ফল হিসেবে নিজেদের জীবনে সেসবের প্রয়োগ করতে উৎসাহিত হয় নি। বরং শাসক শ্রেণির লুম্পেন চরিত্র, নিজেদের জীবনের অনিশ্চয়তা প্রভৃতি দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের বৃত্তে আটকে থাকছে। তার মানস জীবন ও জীবন অভ্যাস হয়ে পড়েছে বিশৃঙ্খল, উদ্দেশ্যহীন ও হতাশাগ্রস্ততার নির্মম নজির।
এই রকম অসুস্থ ও দিশাহীন আবহের মধ্যে থেকে স্বাভাবিক-স্বতঃফূর্ত-সবল কোনো রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক ধারা বেড়ে উঠতে পারে না। তরুণদের সাংগঠনিক সমষ্টিবদ্ধতার প্রক্রিয়াও সবল ভিত্তির ওপর ধারাবাহিকতার মধ্যে পরিচালিত হতে পারে না। চিন্তা কাঠামো বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ ও সজীব উপাদানে শক্তিশালী হতে পারে না। ফলে যা হয় তা হলো, তরুণদের ব্যাক্তিত্ব্য হলো অসামাজিক ও দায়হীন। তাদের চিন্তা নিজেদের জীবন জগৎকে বুঝতে অক্ষম হয় বা কিছুদূর বুঝলেও তাকে পাল্টাতে নিরুৎসাহী হয়ে থাকে। অর্থাৎ চিন্তা ও কর্মের মধ্যে বিস্তর ফারাক দাঁড়িয়ে যায়। হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্নতার শিকার। এই বিচ্ছিন্নতার দুটো দিক আছে। প্রথমত, তা নিজ শ্রেণি বা বর্গ থেকে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, তা জনগণের ব্যাপক অংশ থেকেও বিমুখ করে রাখে। এই হতাশা এই বিচ্ছিন্নতা এই নৈরাশ্য থেকেই সে সন্ত্রসী হয় অথবা সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত হয়। মাদক ও যৌন ব্যবসার মাধ্যম বা লক্ষ্যবস্তুতে পর্যবসিত হয়। হয়ে উঠে শাসক-সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণজালের ক্রীড়ানক। তখন ব্যাক্তিকেন্দ্রীকতার গহ্বরে আটকে থেকে অসহায়-অসংগঠিত ক্রোধ প্রকাশে কিংবা আক্ষেপ হাহাকারের মধ্যেই তার সমস্ত শক্তি, সমস্ত সক্রিয়তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই অবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষে মানুষে ভাঙ্গন।
একটি সমাজ যখন বিদ্যমান সমাজের মধ্যে মীমাংসাতীত সংকটে পড়ে তখন তার প্রথম এবং সর্বোচ্চ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় সামজিক সম্পর্কের ভাঙ্গনের মধ্যে, সম্পর্কের আদল পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে। মানুষ তখন পরিচিত সম্পর্কের প্রতি তা যতই পবিত্র, আস্থাশীল, প্রয়োজনীয় কিংবা ব্যবহারিক বলে মনে হোক, তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে, পাল্টাতে চায়। এই চাপ থেকেই তৈরি হওয়া সম্ভব নতুন সমাজের অগ্রসর মানবিক সম্পর্ক। কিন্তু সেই চেষ্টা যখন দূর্বল থাকে, তার পথ ও প্রক্রিয়া যখন অস্পষ্ট থাকে তখন বিকৃতির জন্ম হয়। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষে, আত্মীয়-পরিজনে, শাসক-শাসিতে, ভাব-কাজে এবং চূড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কে এই ভাঙ্গন এবং তৎজনিত ক্ষোভ-বিকার এখন আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এটা হলো পরিস্থিতির ক্ষয়ের দিক, হতাশার দিক। কিন্তু একটু গভীরভাবে নজর দিলেই বোঝা যাবে এবং যাচ্ছে যে, এই ক্ষয় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা এবং তার মতাদর্শের ক্ষয়। এই হতাশা বর্তমানে যেভাবে জীবন যাপন চলছে, যে ক্ষমতা কাঠামো এভাবে চলতে বাধ্য করছে তার সম্পর্কে হতাশা। যে প্রতিবাদ কোনো লক্ষ্য না পেয়ে সন্ত্রাসের দিকে যাচ্ছে, আত্মধ্বংসী আসক্তির দিকে ঝুঁকছে তার প্রকৃত ও অনিবার্য লক্ষ হলো, যেখানে সমস্যার কারণ সেখানে আঘাত করা, তাকে পাল্টানো এবং উন্নত জীবন ও তার ভাবাদর্শিক আয়োজনকে সংগঠিত করা। এই কাজের অপরিহার্যতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি করে আমাদের সামনে উপস্থিত। কেননা অসন্তোষের পথ ধরে পুরো সমাজের মধ্যে তো বটেই, এমনকি সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার অগ্রণী অংশের মধ্যে ভিন্নমত ও বিরোধী চিন্তার উন্মেষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর জন্ম এই সামাজিক অসন্তোষের ভেতরে, তৎজাত ভিন্নমত-বিরোধী চিন্তা এবং প্রতিবাদী তৎপরতার গর্ভে। এই চিন্তা ও তৎপরতাকে আমরা আমাদের সাধ্যমত বিকশিত করেছি, করবার চেষ্টা করেছি। সেই প্রয়োজনেই ছাত্র সমাজের মধ্যে নবীন বিদ্বৎ সমাজের মধ্যে যে শারীরিক প্রতিরোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের বাস্তব শর্ত তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র ও অঙ্গনে তার যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভব দেখা দিচ্ছে তার সঙ্গে আমরা আমাদের উদ্যোগ ও আয়োজনকে যুক্ত করতে চাই। একত্রিত হয়ে লড়াইয়ের উপাদানকে, প্রতিরোধের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে অভিন্ন শত্রুর সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে চাই। কেবল এর মাধ্যমেই সম্ভব পরিস্থিতির এই জটিল ও হতাশাজনক চিত্রকে ঢেকে দিয়ে, অচলতার জলাশয়ে স্রোত সৃষ্টি করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তো বটেই ছাত্র সমাজের মানসলোককে উজ্জীবিত-সুসংগঠিত ও বিকাশমুখী করা। এই সম্ভাব্যতাই হোক এই মুহূর্তে পরিবর্তনের চেষ্টার বাস্তব চালিকাশক্তি।
এদেশের বিপ্লবী আন্দোলন যখন পরিবেশ আন্দোলন, নারীমুক্তির আন্দোলন, জাতিগত-নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনকে উপেক্ষা কিংবা তার যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনের ব্যার্থ হচ্ছে তখন আমরা আমাদের কর্মসূচী ও রাজনৈতিক শিক্ষার মধ্যে উপরোক্ত ইস্যুগুলোকে মৌলিক গুরুত্ব দিয়েই পরিচালিত করতে চাই। কেননা যা কিছু মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত, যা কিছু সমাজের মৌলিক অংশ এবং যা কিছু লুটেরা সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ-নির্যাতনের শিকার তার সবই আমাদের আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত। তার সবকিছুকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে কোনো প্রকৃত মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। সেকারণে নারী পরিবেশ জাতি প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের শিক্ষা আন্দোলন তথা বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বলে মনে করি। এবং সেই চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি। তরুণ ছাত্ররা সমাজের সেই অংশ যারা এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হন। শিক্ষার্থী হিসেবে, নবীন বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মী হিসেবে এ সব প্রশ্নের মোকাবেলা না করলে, ছাত্র আন্দোলনের এইসব প্রতিবন্ধকের ফয়সালা না হলে শুধু ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র সংগঠন কেন কোনো অগ্রসর চিন্তা, অগ্রবর্তী পদক্ষেপ কী রাজনীতি কী সাংস্কৃতি কী ব্যাক্তিত্ব নির্মাণ কোনো ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। একই কারণে সংগঠন বিকাশ কিংবা প্রতিবাদ- প্রতিরোধ প্রচেষ্টা, সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি কিংবা এবং সংগঠনের ব্যবহারিক সাংস্কৃতির মধ্যে পূর্বোল্লেখিত পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে রাজনীতি হবে সংগঠন হবে আন্দোলন হবে কিন্তু সেই রাজনীতি সেই
সংগঠন সেই আন্দোলন বুর্জোয়া রাজনীতির বিষাক্ত বৃত্ত ছিন্ন করে, অগণতান্ত্রিক, অবৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি পরিহার করে, ছাত্রদের বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণ শৃঙ্খল ভঙ্গ করা তো আকাশকুসুম, নিজেদের সামান্যতম বিকাশ সাধনেও ব্যর্থ হবে। আমাদের পথের এই সব বাধা চিন্তার এই সব ক্ষয় রোধ করে নতুন যুগের নতুন কাজ গড়ে তুলে শিক্ষা- সাংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের বিনির্মাণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির সহায়ক ছাত্র আন্দোলন দাঁড় করানো এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক দায়। সেই দায় মেটাতে পারে বুর্জোয়া প্রবণতামুক্ত, তা থেকে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা অহমিকা জটিলতামুক্ত নতুন ধরনের কর্মী, সংগঠক, প্রতিবাদী ব্যাক্তিত্বরা। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন সেই কর্মী তৈরির পাঠশালা; সেই কর্মকাণ্ডেরই উদ্বোধক।
পয়সার জোরে সমাজের যে কোনো স্তরে ওঠার বাসনা যে সকলের জীবনেই সফল হবে- তা নয়। বরং সিড়ির আকাঙিক্ষত ধাপটি বেশিরভাগ লোকেরই নাগালের বাইরে থেকে যায়, কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে নিচেও গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাসনা পুষতে বাধা কোথায়? পোষা বাসনাটি দিনদিন ফাপেঁ এবং কেউ কেউ ভাবতে শুরু করে যে গন্তব্যে পৌঁছতে আর দেরি নাই। সুতরাং জীবনযাপনের মান ও পদ্ধতি এবার পাল্টানো দরকার।? – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত © 2024 | বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন