১৪ই ফেব্রুয়ারী রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস
যত দিন যাচ্ছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস ততই প্রাসংঙ্গিক হয়ে উঠছে। হিটলার, মুসোলিনী, আইয়ুব, এরশাদ টেকে নাই, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী দুঃশাসনও চিরকাল টিকবে না! শহীদ জয়নাল, জাফর, দিপালী, কাঞ্চনের রক্তের কসম- পরিবর্তন আসবেই।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ক্যু করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে এদেশের ছাত্র সমাজ তা মেনে নেয় নি। ২৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে এরশাদ বিরোধী পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হন শিবলী ইউসুফ, হাবিব ও আ. আলী। তাঁদেরকে সাত বছরের জেল দেয়া হয়। ২৬ তারিখ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের সময় ছাত্র সংগটনের নেতাকর্মীরা সামরিক সরকার এরশাদবিরোধী শ্লোগান দিলে সেখানেও ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন করা হয়।
জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে এরশাদ তার দুঃশাসন দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। তারই অংশ হিসেবে কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের গৃহিত নীতিগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। প্রাথমিক স্তরেই বাংলার সাথে ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দেয়। শিক্ষা ব্যয়ের ৫০% ছাত্রদের উপর বর্তানো হয়। রেজাল্ট খরাপ করা সত্ত্বেও শিক্ষা ব্যয়ের ৫০% বহন করতে পারলেই তাকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে বলে মজিদ কমিশনের নীতিতে সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মজিদ খানের এই জনবিরোধী অগণতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির ব্যাপক বিরোধিতা করা হয়।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধসহ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ছাত্ররা সারাদেশে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ১৪ টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মিছিল-সমাবেশ, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান, ছাত্র ধর্মঘটসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে লাগাতার কর্মসূচি চলতে থাকে । আন্দোলন দমন করতে ছাত্র ইউনিয়নের তৎকানীন সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে গ্রেফতার করলে সারাদেশে ছাত্ররা আরো ফুঁসে ওঠেন। ১৯৮৩ সালের ২৭, ২৮ জানুয়ারি সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এরপর এরশাদ সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ছাত্রবন্ধীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধের দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বটতলায় জমায়েত হয়ে হাজার হাজার ছাত্র সচিবালয় ঘেরাও করতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে অগ্রসর হয়। মিছিল হাইকোর্টের মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। বাংলা একাডেমি থেকে হাইকোর্টের গেট পর্যন্ত দীর্ঘ মিছিলটি ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে। নেতৃবৃন্দ ব্যারিকেডের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে থাকেন। ব্যারিকেডের পাশ দিয়ে রায়টকার এনে ছাত্রদের ওপর গরম পানি, টিয়ার গ্যাস ছুড়ে মারা হয়। এরপর গুলি শুরু হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জয়নাল। শিশু একাডেমির ভিতরে ঢুকে শিশু-অভিভাবকদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও গুলি চালানো হয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে দিপালী সাহা নিহত হন। পুলিশের গুলিতে নিহতদের সংখ্যা ও নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলে। একই সাথে বাড়তে থাকে প্রতিরোধ মিছিলে পা এবং মুষ্টিবদ্ধ হাতের সংখ্যাও। শাসকরা তখন মানুষের অধিকার কেড়ে নেয় তখন প্রতিবাদী মানুষ অধিকার ও মর্যাদার জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে একটু ও বিচলিত হয় না। শাসক ও রাষ্ট্রের চরিত্র কী ভয়ানক তা কবি হাবিব জালিবের একটি কবিতায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে-
“বাঁচার অধিকার তো রাষ্ট্র কেড়েই নিয়েছে
ওঠো, মরার অধিকার ভোগ করো।
জিল্লতির জীবন থেকে মরাই ভালো
হয় ধ্বংস হয়ে যাও, নয়তো অত্যাচারীর অট্টালিকা পদদলিত করো।
রাষ্ট্রের বন্ধুরা আমাদের শত্রু।
ওদের জন্যই ঘরে ঘরে কাঁন্না আর আহাজারি।
ওদের জন্যই গণহত্যার শিকার হয়েছে আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্নগুলো।
ওদের জন্যই বিরান হয়েছে কাঙ্ক্ষিত পুষ্পোদ্যান।
ভাইয়েরা! ক্ষুধা, অপমান সব ওদেরই দান।
ভুলেও ওদের কাছে হালত বয়ান করো না।
বাঁচার অধিকার তো রাষ্ট্র কেড়েই নিয়েছে
ওঠো, মরার অধিকার ভোগ করো।
ফিলিস্তিনে সকাল সন্ধ্যায় রক্ত ঝরে
সেই কবে থেকে মানুষ মৃত্যুর আশ্রয়ে আছে
বন্ধ করো উর্দিওয়ালাদের সন্ত্রাস, গুণ্ডামি।
বন্ধুগণ! দুনিয়া তো একটি কথাই বলছে-
জালিম থাকতে শান্তি কিভাবে সম্ভব?
ওদেরকে হটিয়ে পৃথিবীতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করো।
বাঁচার অধিকার তো রাষ্ট্র কেড়েই নিয়েছে।
ওঠো, মরার অধিকার ভোগ করো।”
(ওঠো, মরার অধিকার ভোগ করো -কবি হাবিব জালিব; তরজমা: ওমর ফারুক বিশ্বাস)
দিপালী সাহার মৃত্যুর পর পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিতভাবে নির্যাতন করে। কলাভবনের ভিতর থেকে খ. ম. জাহাঙ্গীর নামে একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে। বিকেলে উপাচার্য কার্যালয়ে হামলা করে পুলিশবাহিনী। সেখানে অবস্থানরত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বেধড়ক মারপিট করে পুলিশ। পিটিয়ে অনেক শিক্ষার্থীর হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়। উপাচার্য কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কার্জন হলের সামনে পড়ে থাকা জয়নালের লাশ সরিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের ডাইনিং রুমে লুকিয়ে রাখা হয়। পুলিশ হন্যে হয়ে লাশ খুঁজতে থাকে। সব আবাসিক হলে তল্লাশি চালাতে থাকে এবং শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতন ও আটক করতে থাকে। পরে জয়নালের লাশ বের হলে তল্লাশি বন্ধ হয়। সরকারি হিসেব মতে, জয়নাল, জাফর, দিপালী, কাঞ্চনসহ সারাদেশে ১০ জন শহীদ হন। আহত হন কয়েক’শ আন্দোলনকারী। সারাদেশে ১৩৩১ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। কোনো কোনো সূত্র মতে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৪৯ জন। সবার লাশ পাওয়া যায় নি, লাশ গুম করা হয়েছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হামলা হলে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তোলারাম কলেজসহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ হামলার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিভিন পেশাজীবী জনতাও যুক্ত হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় সারাদেশে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠেন। ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস ও জেলা শহরে হরতাল পালিত হয়। চট্টগ্রামে হরতাল চলাকালে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাঞ্চন ও একজন স্কুলছাত্র।
১৪ তারিখ বিকেলেই সেনাবাহিনী নামানো হয়। ১৬ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মিলে শিক্ষার্থীদেরকে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে গুরুতর আহত করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সব নিপীড়ন, হামলা, গুলি উপেক্ষা করে গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ছাত্রবন্ধীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধের দাবিতে তীব্র প্রতিবাদ চলতে থাকে। শিক্ষার্থীদের অকুতোভয় অগ্নিস্ফূলিঙ্গ প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার মাথানত করে। ১৭ ফেব্রয়ারি আটককৃতদের মধ্যে ১০২১ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের শিক্ষানীতি স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার।
১৯৮৩ সালে ছাত্রসমাজের বারুদ গন্ধে মাতাল শ্লোগান মিছিলের তোপে কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। শহীদ জয়লাল, জাফর, দিপালী, কাঞ্চনের প্রতিবাদী রক্তের ফিনকির চাপে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বাধ্য হয়ে মজিদ খান কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করে। আর তখন থেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাধ্বংসী, ঘুষখোর ও নিমকহারাম প্রত্যেক শিক্ষামন্ত্রীকেই একদিন ছাত্র-জনতার আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। জনগণের করের টাকায় শিক্ষা বাজেট হয়। কথা ছিলো আমাদের শিশুরা, শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা পাবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হবে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী শিক্ষাকে ধ্বংস ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মেধাশূন্য করার কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট সর্বস্ব ডিগ্রীধারী নতজানু রাজনৈতিক চৈতন্যহীন মেরুদণ্ডহীন দাসসুলভ মাংসপিণ্ডে পরিণত করে চলেছে। রাষ্ট্র নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে বারবার জনগণের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে। দেশকাল ভেদে শাসকগোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদী ও নিপীড়নমূলক শাসন শোষণে জনজীবন বারবার বিপর্যস্ত চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। নিপীড়িত মানুষেরাও প্রতিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা ও তল্পিবাহকদের উচ্ছেদ করেছে।
শিক্ষাধ্বংসী সরকার হিসেবে আওয়ামী সরকারকেও গণআদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ক্যু করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে শিক্ষার্থীরা শ্লোগান তুলেছিল, ‘সামরিকতন্ত্রে লাথি মার, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আন।’ এখন আমরা শ্লোগান তুলছি- আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রে লাথি মারো, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনো। এরশাদ গেছে যেই পথে, হাসিনা যাবে সেই পথে। কোনো দুঃশাসনই বেশি দিন টেকে না। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাল-সেন-মুঘল-সব শাসনেরই পতন হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও চিরস্থায়ী হয় নি। ৫০ বছর ধরে যে শাসকগোষ্ঠী বারবার জনগণের সাথে প্রতারণা করে চলেছে তাদের তখতেতাউস চুরমার হবেই হবে।
গোলাম মোস্তফা
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন